রাত সাড়ে দশটার ট্রেন (ভূতুড়ে স্টেশন)
আমিও আর কয়েকটা সাধারণ মানুষের মতো ভূতে বিশ্বাস করতাম না। ভাবতাম সব মনের ভুল ভূত বলে কিছু হয় না। কিন্তু আমার সমস্ত বিশ্বাস-অবিশ্বাস বদলে দেয় সেই একটি রাত ।সেই রাতের পর থেকে আমার দৃষ্টিকোণ বদলে গেছে ।সেই রাতের পর থেকে আজও আমি সাসপেন্সে আছি,আজও আমি বুঝতে পারছি না সেদিন কেন আমার সাথে এমন ঘটেছিল ।
সেটি ছিল 19 সেপ্টেম্বর 2016 এর রাত বারটা ছিল সোমবার ।
বলে রাখা ভালো আমি বাঙ্গালবাড়ি SBI ব্যাংকে ম্যানেজারের পদে চাকরি করি ,তবে আমার বাড়ি বাঙ্গালবাড়ি থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে রায়গঞ্জে। তাই প্রতিদিন সকাল 10 টার ট্রেনে আমাকে রায়গঞ্জ থেকে বাঙালবাড়িতে আসতে হয় এবং রাত সাড়ে 10 টার ট্রেনে আবার বাঙ্গালবাড়ি থেকে রায়গঞ্জে অর্থাৎ বাড়িতে ফিরতে হয়। এভাবে দেখতে দেখতে চার চারটি বছর কেটে গেছে কিছু অস্বাভাবিক পরিস্থিতি হয়নি। কিন্তু সেই রাত, সেই দিনের রাত আমার জীবন বদলে দেয় ।সেই দিনের রাত অর্থাৎ 19 শে সেপ্টেম্বর 2016 সোমবারের আগে শনিবার হাফ অফিস থাকায় বিকালের দিকেই আমি গাড়ি করে রায়গঞ্জে ফিরে যাই । সেদিন আর রাত সাড়ে 10 টার ট্রেনে বাড়ি ফেরা হয়নি । রবিবার অফিস ছুটি ছিল তাই পর পর দুই দিন রাত সাড়ে 10 টার ট্রেনে করে বাড়ি ফেরেনি।
তারপরে সোমবার অর্থাৎ 19 শে সেপ্টেম্বর 2016 তারিখে অফিস শেষে টোটো করে স্টেশনে পৌছালাম।
মোবাইলটা বার করে সময় দেখি ঘড়িতে ১০.২৫ বাজে।
স্টেশনে উঠেই একটা অন্যরকম অনুভূতি হলো। এত দিনের চেনা স্টেশনকে আজ অন্য রকম মনে হল। চারদিক দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কোন লোকজন নেই ধূধূ ফাকা প্লাটফর্ম। শুধুমাত্র চায়ের দোকানে বসে একটি লোক হিসাবে ব্যস্ত । কোন দিকে কোন লোক দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ আমার মনে খটকা লাগলো । প্রতিদিন তো আমি এই স্টেশন দিয়েই যাতায়াত করি। প্রতিদিন তো বহু লোকের হট্টগোল থাকে ।অন্তত 10-15 জন লোক ট্রেনে উঠে এবং 10-15 জন লোক ট্রেন থেকে নামে । কিন্তু হঠাৎ আজ পুরো স্টেশন ফাঁকা কেন ? আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে টিকিট কাউন্টারে দাঁড়ালাম। টিকিট মাস্টার আমাকে টিকিট দিয়ে জানালো যে ট্রেন আধাঘন্টা লেট আছে। আমি টিকিট নিয়ে একটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়লাম । সারাদিন কাজের প্রচন্ড চাপ থাকায় পেপারটি পড়া হয় নাই তাই আমি পেপারটি বার করে পড়তে শুরু করলাম কিন্তু কোনো রকম কোনো মজাদার বা ইন্টারেস্টিং খবর না পেয়ে পেপারটি রেখে দিলাম ।
হঠাৎ পিছন থেকে একটা মেয়ের দৌড়াতে দৌড়াতে এসে প্রচন্ড উচ্চকণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞাসা করল- "আচ্ছা রাত সাড়ে দশটার ট্রেনটা কি চলে গেছে?"আমি তার কথায় হঠাৎ চমকে গেছিলাম আমি তাকে শান্ত গলায় বললাম আপনি শান্ত হোন ট্রেন আধাঘন্টা লেট আছে।
তিনি তখন হাত ছেড়ে বসলেন আমি আমার ব্যাগের ভেতর থেকে জলের বোতলটা বার করে তাকে দিলাম তিনি এক নিঃশ্বাসে সমস্ত জল খেয়ে ফেললেন আমি এতে কিছু মনে করলাম না।এবার আমি তাকে ভালো করে দেখলাম সে একজন কুড়ি বাইশ বছরের সুন্দরী যুবতী মহিলা পরনে লাল চুড়িদার ও সাদা ওড়না। কথায় কথায় জানতে পারলাম তার বাড়ি বাঙ্গালবাড়ির পাশের গ্রাম কমলপুরে ।সে একটি ছেলেকে ভালবাসে তাই আজ সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে ছেলেটির সাথে পালিয়ে যাওয়ার জন্য ।কিন্তু স্টেশনে এসে তার প্রেমিককে এখনো না আসতে দেখে সে খুবই চিন্তিত ।কথায় কথায় সেও জানতে পারে যে আমি রায়গঞ্জে থাকি তাই সে আমার কাছে একটি অনুরোধ করে যে আজকে রাতটা আমি যেন তাদের রায়গঞ্জে থাকার ব্যবস্থা করেদি। আমি তাতে রাজি হয়ে যাই।
তারপর সেই মেয়েটি সেখান থেকে উঠে চলে যায় তার প্রেমিক কে খোঁজার জন্য। আমাকেও বসে থেকে থেকে বোরিং লাগছিল তাই আমি উঠে গিয়ে চায়ের দোকানে যে লোকটি বসে ছিল তার কাছে গিয়ে বসলাম ।কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেই ফেললাম - "আচ্ছা আমি তো প্রতিদিন এই স্টেশন দিয়ে যাতায়াত করি প্রতিদিন তো কমপক্ষে 10 15 জন লোক ওঠে 10-15 জন লোক নামে কিন্তু হঠাৎ আজ পুরো স্টেশন থাকা কেন"? তিনি বললেন -"কেন আপনি কাল আসেনি"? আমি বললাম-"কেন কি হয়েছিল গতকাল"? তিনি বললেন -" গত শনিবার বাঙ্গালবাড়ি পাশের গ্রাম কমলপুরের একটি কুড়ি বাইশ বছরের যুবতী মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল তার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু ট্রেন চলে আসলেও যখন মেয়েটি দেখছে যে তাঁর প্রেমিক আসছে না তখন রাগ ক্ষোভ ও অভিমানে সেই ট্রেনেই ঝাঁপ দিয়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল । তাই গত রবিবার বহুলোক ভয় স্টেশনে আসেনি মাত্র দু একজন লোক এসেছিল তার মধ্যে একটি লোক একটি মেয়েকে দেখে ছিল । সেই কুড়ি বাইশ বছরের মেয়েটিকে আসলে সেই লোকটি দেখেছিল এবং সেই মেয়েটি সেই লোরটির সাথে কথা বলে এবং রাত সাড়ে দশটার ট্রেনটা যখন চলে আসে তখন সেই মেয়েটি অর্থাৎ মেয়ের আত্মাটি সেই লোকটিকে ঠেলে দিয়েছিল সেই ট্রেনে । ফলে গত রবিবার একটি লোক ট্রেন নে মারা গিয়েছিল। পরপর দু'দিন ট্রেনের মধ্যে আত্মঘাতী ঘটনা ঘটায় লোক আর আজ আর ভয়ে স্টেশনে আসেনি"- এবং সাথে সাথে তিনি আমার হাত থেকে প্যাপারটি নিয়ে গত দু'দিনের ঘটে যাওয়া খবর দুটি আমাকে দেখিয়ে দিলেন । এবার যা দেখলাম তা দেখে আমার সারা শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠেছে , রক্ত হিম হয়ে গেছে ভয়ে আমি কথা বলতে পারছি না মুখ শুকিয়ে গেছে আমি এক জায়গায় স্থির হয়ে গেছি আর নড়াচড়াও করতে পারছি না কারণ যে মেয়েটির ছবি আমি দেখতে পাচ্ছি সেটি আর সে কোন মেয়ে না সেটি সেই মেয়ে যার সাথে এতক্ষণ আমি কথা বলছিলাম । তারপর যে ছবিটি দেখলাম , গত রবিবারে যে লোকটি মারা গেছে সেই লোকটি আর কেউ না সেই লোক যিনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি আমাকে গত দু'দিনের ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত করলেন । আমি আর স্থির থাকতে পারছি না মনে হয় এই জ্ঞান হারাবো এই জ্ঞান হারাবো এত ভয় পেয়েছি এত ভয় পেয়েছি এমত অবস্থায় কানে একটা আওয়াজ আসলো - টটোওয়ালা বলে উঠলো-"স্যার স্টেশনে পৌঁছে গেছি" ।
তাহলে এটা কি স্বপ্ন ছিল এতক্ষণ কি আমি স্বপ্ন দেখছিলাম । এটা কি সত্যি স্বপ্ন ছিল । এত স্বচ্ছ ও পরিষ্কার যে স্বপ্নের প্রতিটা দৃশ্য প্রতিটা কথা আজও আমার মনে আছে। টোটো থেকে নেমে মোবাইলটা বার করে সময় দেখি 10:25 বাজে। ষ্টেশনে উঠতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো স্বপ্নের যা যা দেখেছিলাম যেমনটা দেখেছিলাম - পুরো স্টেশন ফাঁকা, চারিদিকে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কোন লোকজন নেই শুধু ধূধূ ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম এবং চায়ের দোকানে বসে আছে সেই লোকটি। সাথে সাথে পেপারটির কথা মনে পড়ল। ব্যাগ থেকে পেপারটি খুলে দেখলাম ঘটনা টা সত্যি গত দুদিন দুটি লোক মারা গেছিলো ট্রেনে ঝাঁপ দিয়ে । আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছি, সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছে রক্ত হিম হয়ে গেছে আমি নড়তে পারছি না একই জায়গায় অচল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি । এমন সময় আমি বুঝতে পাড়ি যে কেউ যেন আমার পিছন থেকে প্রচন্ড জোরে দৌড়ে আসছে । আমার আর বুঝতে বাকি থাকে না যে এটা আর কেউ না এটা সেই মেয়েটা, আমাকেও সে মেরে দিবে । আমি সরে পড়ার প্রচন্ড চেষ্টা করছি কিন্তু আমি সরতে পাড়ছি না ভয়ে । তারপর আর কিছু মনে নেই । পরের দিন সকালে যখন আমার জ্ঞান ফিরে দেখি আমি বাঙ্গালবাড়ির হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি । সেই দিনের পর থেকে আজও আমাকে একটা ভয় তাড়া করে বেড়ায়। আজও আমি বুঝতে পারছি না সেদিন কেন আমার সাথে এমন ঘটেছিল , আজও আমার মনে হয় কেউ আমাকে পিছন থেকে ডাকছে, মনে হয় আমার পিছন পিছন কেউ দৌড়ে আসছে ।একটা ভয় সব সময়ই তাড়া করে বেড়ায় সেদিনের পর থেকে আমি পুরোই বদলে গেছি। বদলে গেছে আমার দৃষ্টিকোণ , আমার বিশ্বাস অবিশ্বাস।
- সাহাদাত হোসেন
- সাহাদাত হোসেন
No comments:
Post a Comment